মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১) | Mir Mosharraf Hossain ( 1847–1911 or 1912)
মীর মশাররফ হোসেন ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার লাহিনীপাড়ার এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক। ছদ্মনাম- গাজী মিয়া। পিতা মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন জমিদার। তার পূর্বপুরুষ সৈয়দ সাদুল্লাহ ইরাকের বাগদাদ থেকে দিল্লিতে এনে মোগল সেনাবাহিনীতে চাকুরী নেন। মোগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে বাংলাদেশের ফরিদপুরে চলে আসেন।
o স্কুল জীবন কাটে প্রথমে কুষ্টিয়ায়, পরে পদমদী এবং শেষে কৃষ্ণনগরে। পিতৃবন্ধু নাদির হোসেনের বাসায় থেকে কলকাতা কালীঘাট স্কুলে কিছুদিন পড়াশুনা করেন।
o কলকাতায় থাকাকালে নাদির হোসেনের সুন্দরী কন্যা লতিফননেসার সাথে প্রথমে প্রেম এবং পরে বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু বিবাহ অনুষ্ঠানে কন্যা বদল করে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী আজিজুননেসার সাথে তার বিয়ে (১৮৬৫) দেওয়া হয়। পরিণামে। লতিফননেসা আত্মহত্যা করলে তিনি আজিজুননেসাকে ক্ষমা করতে পারেন নি। দাম্পত্য জীবন সুখী হয় নি।
o বিয়ের আট বছর পর ১৮৭৩ সালে সাওতা গ্রামের এক বিধবা কালী ওরফে বিবি। কুলসুমকে বিয়ে করেন। টাঙ্গাইলের শান্তিকুঞ্জে’ বিবি কুলসুমকে নিয়ে বসবাস করতেন।
o কাঙাল হরিনাথ ছিলেন তার সাহিত্য শুরু।
o ১৯১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দির পদমদীতে মৃত্যুবরণ করেন।
সাহিত্যকর্ম
o মীর মশাররফ হোসেন সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার মোট ৩৭টি গ্রন্থ রচনা করেছেন।
o উপন্যাস
রত্নবর্তী (১৮৬৯, প্রথম গ্রন্থ)। মুসলিম রচিত প্রথম বাংলা উপন্যাস। গুজরাট নগরের রাজপুত্র ও মন্ত্রীপুত্রের কল্পিত কাহিনি অবলম্বনে উপন্যাসটি রচিত। এটি রূপকথার মাধ্যমে শিক্ষামূলক একটি দীর্ঘ গ রাজপুত্র সুকুমার ও মন্ত্রীপুত্র সুমন্তের মধ্যে ধন বড় না বিদ্যা বড় এ বিতর্ক ও বিতর্কের সমাধানই এ গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় ।
গ্রন্থপরিচিতি
বিষাদ সিন্ধু (১৮৮৫-১১)। তার শ্রেষ্ঠ রচনা। কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনাই এর মূল উপজীব্য। এর প্রধান চরিত্র এজিদ। তার কামনা বাসনাকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের সূচনা এবং শোচনীয় বিপর্যয়ের মাধ্যমে কাহিনির সমাপ্তি।
- উদাসীন পথিকের মনের কথা (১৮৯০)। আত্মজীবনীমূলক রচনা। উদাসীন পথিক ছদ্মনামে লিখেছেন। এতে নীলকর কেনির অত্যাচার ও কৃষক ভূস্বামীদের প্রতিরোধের মুখে মি. কেনির শোচনীয় পরাজয় এ গ্রন্থের প্রধান বিষয়। এর উল্লেখযোগ্য চরিত্র- নীলকর টমাস আইভান (টিআই) কেনি, মহিলা জমিদার প্যারীসুন্দরী, মীর মোয়াজ্জেম হোসেন, পা গোলাম প্রমুখ।
• মিনা (১৮৯৭)।
গাজী মিয়াঁর বস্তানী (১৮৯৯)। আত্মজীবনীমূলক রচনা।
o নাটক
• বসন্তকুমারী (১৮৭৩) বাংলা সাহিত্যে মুসলিম রচিত প্রথম নাটক।
• জমিদার দর্পণ (১৮৭৩)।
• বেহুলা গীতাভিনয় (১৮৯৮)। এতে ইংরেজ শাসকদের প্রকৃত স্বরণ উম্মোচন করে তাদের প্রতিরোধ করার আহবান জানিয়েছেন।
• নিয়তি কি অবনতি (১৮৯৮)।
o প্রবন্ধ
• গো-জীবন (১৮৮৯)। এ গ্রন্থে তিনি হিন্দু মুসলিম ঐক্য দয় করতে গরু কোরবানীর বিপক্ষে মত দেন। ফলে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশ দেয় প্রবন্ধটি পুনর্মুদ্রণ না করার জন্য।
এসলামের হয় (১৯০৮)
o প্রহসন
এর উপায় কি? (১৮৭৫)। এতে উনিশ শতকে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উচ্ছৃংখলতা বাঙ্গাকারে তুলে ধরা হয়েছে।
• টালা অভিনয় (১৮৯৭)
- ভাই ভাই এইতো চাই (১৮৯৯)
• ফাঁস কাগজ (১৮৯৯)
• বাঁধা খাতা (১৮৯৯)
• গড়াই ব্রিজ বা গৌরী সেতু (১৮৭৩)
o কাব্য
• পঞ্চনারী (১৮৯৯)
• মদীনার গৌরব (১৯০৬) • মোসলেম বীরত্ব (১০৭)
বাজীমাত (১৯০৮, নকশা জাতীয় কাব্য)
- আমার জীবনী (১৯০৮-১০)। এ গ্রন্থটি বার খণ্ডে সমাপ্ত হয়। এতে লেখকের ১৮ বছরের জীবনী তুলে ধরা হয়েছে।
• আমার জীবনীর জীবনী বা কুলসুম জীবনী (১৯১০, সর্বশেষ গ্রন্থ)।
o গানের সংকলন সঙ্গীত লহরী (১৮৮৭)।
o বিখ্যাত উক্তি–
• মাতৃভাষায় যাহার ভক্তি নাই সে মানুষ নহে।
o সম্পাদিত পত্রিকা
ছাত্রাবস্থায়ই সংবাদ প্রভাকর (১৮৩১) ও গ্রামবার্তা প্রকাশিকা (১৮৬৩) পত্রিকায় মফস্বল সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করেন।
আজিজননেহার (১৮৭৪) ও হিতকরী (১৮৯০) পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
জেনে রাখা ভাল
• মীর মশাররফ হোসেনের প্রথম জীবনী লিখেছেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি মীর মশাররফ হোসেনকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। সাথে তুলনা করেছেন।
গ্রন্থপরিচিতি
বিষাদ সিন্ধু :-
বিষাদ-সিন্ধু মীর মশাররফ হোসেনের ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস। হিজরি ৬১ সালের মহররম মাসে নবী নন্দিনী ভারত ফাতেমা (রা.)-র ছেলে হোসাইনের সঙ্গে উমাইয়া খলিফা মুয়াবিরার একমাত্র পুত্র এজিদের কারবালার প্রান্তরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এবং ইমাম হোসাইনের স্বপরিবারে শাহাদাতের কাহিনিই ‘বিষাদ সিন্ধু’র মূল আলোচ্য বিষয় টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার অবস্থানকালে উপন্যাসটি রচনা করেন।
উপন্যাসটি তিন পর্বে বিভক্ত- মহররম পর্ব, উদ্ধার পর্ব ও এজিদব পর্ব। এতে উপসংহারসহ সর্বমোট ৬৩টি অধ্যায় রয়েছে। বিষাদ-সিন্ধুর সূচনা হয়েছে- হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর এক ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে এবং ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রন্থের উপসংহার ঘটে।
বিষাদ- সিন্ধুর অধিকাংশ ঘটনাই জয়নবকে কেন্দ্র করে। মুয়াবিয়া পুত্র এজিদের প্রণয়াসক্তির ব্যর্থতা ও পরিণতির এই কাহিনি নিয়ে প্রথম পর্ব ( মহররম)। দ্বিতীয় খণ্ডে (উদ্ধার পর্ব) আছে বিপন্ন হোসেন পরিবারের অস্তিত্বরক্ষা ও দুর্জয় বীর হানিফার প্রতিশোধ গ্রহণের বিবরণ এবং তৃতীয় খণ্ডে (এজিদ বধ পর্ব) আছে হানিফার এজিদ হত্যার প্রচেষ্টা, দৈব নির্দেশে বহু প্রাণক্ষয়কারী হানিফার প্রাকৃতিক বন্দিত্ব এবং হোসেন বংশধর জয়নালের রাজ্যলাতের কাহিনির বর্ণনা।
লেখক মূল ঘটনার ঐতিহাসিক সত্যতা রক্ষা করেছেন কিন্তু ইতিহাসের অন্ধ অনুকরণ করেননি। হাসান হোসেনের সঙ্গে এজিদের বিরোধ রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বপ্রসূত এ কথা ঐতিহাসিক সত্য।
জমিদার দর্পন :-
মীর মশাররফ হোসেন জমিদার দর্পন’ (১৮৭৩) নাটকে সাধারণ মানুষের উপর জমিদার শ্রেণির নির্মম অত্যাচারের স্বরূপ ফুটিয়ে তুলেছেন। নাটকের কাহিনি হচ্ছে- কৃষক আবু মোল্লা ও তার সুন্দরী স্ত্রী নুরুন্নেহারের সুখী সংসার।
জমিদার হায়ওয়ান আলীর কুনজর পরে নুরুন্নেহারের উপর। কৌশলে সে আৰু মোল্লাকে সর্বসান্ত করে মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠায়। অন্তঃসত্ত্বা নুরুন্নেহার বাধ্য হয়ে স্বামীর মুক্তির জন্য হায়ওয়ান আলীর কাছে যায়। গিয়ে তাকে বাবা বলে সম্বোধন করে।
কিন্তু পশুর থেকেও অধম হায়ওয়ান আলী তার পাশবিকতা চরিতার্থ করলে অন্তঃসত্ত্বা নুরুন্নেহারের অতিরিক্ত। রক্তক্ষরণ জনিত কারণে মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুর দায় এড়াতে হায় ওয়ান আলী ব্রিটিশ শাসকদের উৎকোচ প্রদান করে।
আর তাকে মৃত্যুর দায় থেকে বাঁচানোর জন্য ব্রিটিশ ডাক্তার, পুলিশ ও বিচারক সবাই সব রকম সহায়তা করে। তারা উল্টো স্বামী আৰু মোল্লাকেই খুনী সাব্যস্ত করতে চায়। এভাবে এ নাটকে মীর মশারর জ শাসকশ্রেণীর দালালদের ঘৃণ্য চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।
বসন্তকুমারী
মীর মশাররফ হোসেনের প্রথম নাটক বসন্তকুমারী (১৮৭৩)। ইন্দ্রপুরের বিপত্নীক রাজা বৃদ্ধ বয়সে মন্ত্রীর প্ররোচনায় রেবতী নামে এক যুবতীকে বিয়ে করে । কিন্তু রেবতীর আকর্ষণ রাজাকুমার নরেন্দ্রের প্রতি। সে প্রেম নিবেদন করে নরেন্দ্রকে।
এদিকে বসন্ত কুমারী রাজকুমার নরেন্দ্রকে মাল্যদান করে। বিমাতা রেবতীর কুপ্রস্তাব রাজকুমার প্রত্যাখ্যান করলে রেবতী বড়যন্ত্র করে রাজার কাছে নালিশ করে। রাজা রাজকুমারকে জ্বলন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপের নির্দেশ দেন।
বসন্ত কুমারী স্বামীর সাথে সহমৃতা হয়। পরে রাজ্য রেবতীর লেখা প্রেমপত্র উদ্ধার করে সত্য জানতে পারেন এবং তরবারি আঘাতে রেবতীর মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেন। নাটকের নাম বসন্তকুমারী হলেও রেবতীকে ঘিরেই এ নাটকের কাহিনী আবর্তিত।
উদাসীন পথিকের মনের কথা :-
উদাসীন পথিকের মনের কথা (১৮৯০) মীর মশাররফ হোসেনের আত্মজীবনীমূলক রচনা। একে নির্ভেজাল উপন্যাস বা নিছক আত্মজীবনী কোনটিই বলা যায় না। উপন্যাসের আসলে বাস্তব ঘটনার আলোকে মীর মশাররফ এটি রচনা করেছেন। এতে কুষ্টিয়া অঞ্চলের নীলচাষ ও নীল স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনি বিবৃত হয়েছে।
এর কাহিনি দুটি আলাদা ধারায় বরো গেছে। একদিকে রয়েছে নীলকর টমাস আইভান (টিআই) কেনির সঙ্গে কুষ্টিয়ার সুন্দরপুরের (সদরপুর মহিলা জমিদার প্যারীসুন্দরীর দ্বন্দ্ব, রায়ত-প্রজার ওপর কেনির অত্যাচার, নীল স্বাধীনতা সংগ্রাম ও কেনির পরিণতি।
কাহিনির দ্বিতীয় ধারাটি গড়ে উঠেছে মীর মশাররফ হোসেনের পিতা মীর মোয়াজ্জেম হোসেনের সাথে তার ভাইজি জামাই সা গোলামের তিক্ত সম্পর্ককে কেন্দ্র করে এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মোয়াজ্জেম হোসেনে দাম্পত্যজীবনের ঘটনা। তবে মাঝেমধ্যে দু ধারার কাহিনি একত্রে মিশে গেছে। মীর মোয়াজ্জেম হোসেন এই দুই কাহিনির যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেছেন।